আগে ভাংতি রোযা না শাওয়্যালের রোযা??"


বিতর্কের বেশ পরিচিত একটা টপিক বছর ঘুরেই ফিরে আসে। বিশেষ করে এ বছর দুই প্রান্তিক সীমার মতামত বেশি পাচ্ছি। একদল ভাংতি শেষ করেই শাওয়্যালের প্রস্তুতি নিচ্ছেন, আর এই মতামত শুনে আরেক দল ভাবছেন: নাহ, শাওয়্যালের রোযা আর রাখা হবেনা এবার।
.
দ্বিতীয় পক্ষ এমন ভাবছেন কেন?
.
উত্তরটা দিচ্ছি: মেয়েদের যে ভাংতি রোযা পড়ে, এই বিষয়টা আলোচনা করতে গিয়ে অনেক স্কলারের বক্তব্যেই শুনলাম যারা বলছেন: ৩/৪ টে ভাংতি রেখে তারপর শাওয়্যাল রাখুন। কিন্তু এই ব্যাপারটা আরেকটু আলোচনার দাবি রাখে। মেজরিটির ভাংতি পড়ে ৫/৬ টা, আর অল্প কিছু মানুষের ৩/৪ টা, আর আরেক বড় অংশের ১০/১২/১৪ টাও পড়ে। এত কিভাবে? যে মহিলার রমাদানের শুরুতেই ভাংতি পড়লো হায়েযের কারণে, তারই হয়তো কয়েকদিন এগিয়ে এসে রামাদানের শেষদিকেও ভাংতি পড়লো: এই ঘটনার সংখ্যাও কম নয়। আবার যে মায়েরা নিফাসের মধ্যে আছেন কিংবা ব্রেস্টফিডিং মা, তাদের ভাংতির সংখ্যা আরও বেশি। এই অবস্থায় 'কাযা রেখেই শাওয়্যাল রাখতে হবে' এই অবস্থান কতটা গ্রহণযোগ্য??
.
বিষয়টার মতভেদ নিয়ে কয়েক বছর আগেও কিঞ্চিৎ পড়েছিলাম, এবারও পড়তে হলো। এই বিষয়ে মতভেদের দল মোটামুটি ৩ টি,
.
● আগে ভাংতি শেষ করেই শাওয়্যাল রাখতে হবে।
● আগে শাওয়্যাল রেখেও ভাংতি রাখা যাবে।
● শাওয়্যাল মাসে ভাংতি রোযা রাখলে এবং শাওয়্যালের সাওয়াব আশা করলে আল্লাহ দুটোই দেবেন, ইনশাআল্লাহ।
.
যে হাদীসটি নিয়ে মতভেদ, সেটি হচ্ছে,
.
مَنْ صَامَ رَمَضَانَ ثُمَّ أَتْبَعَهُ سِتًّا مِنْ شَوَّالٍ كَانَ كَصِيَامِ الدَّهْرِ
.
"যে ব্যক্তি রমাদানের রোযা রাখলো, এবং তারপর শাওয়্যালের ৬টি রোযা রাখলো, সে যেন সারাবছর রোযা রাখলো।" [সহীহ মুসলিম]
.
❒ এখানে প্রথমোক্ত মতামতের আলেমরা বলছেন,
.
مَنْ صَامَ رَمَضَانَ
.
যে রমাদানে রোযা রাখলো, এটার অর্থ হচ্ছে, যে রমাদান সম্পূর্ণ করলো তথা সবগুলো রোযা রাখলো।
.
ثُمَّ أَتْبَعَهُ
.
অতঃপর তাকে অনুসরন করলো (শাওয়্যালের ৬ রোযা) অর্থ রমাদানের সব রোযা শেষ করার পর যে ৬ টি রোযা রাখলো- তার জন্যই কেবল সারা বছর রোযা রাখার সাওয়াব।
.
যেহেতু ভাংতি রোযাগুলো পূরণ না করলে ব্যক্তির রমাদানের রোযাই পূর্ণ হচ্ছেনা, সুতরাং প্রথম শর্তই মিলছেনা, তাই সে শাওয়্যালের রোযা রাখলেও সেই সাওয়াব পাওয়ার যোগ্য নয়। তাই আগে ভাংতি রোযা রাখতেই হবে। ইমাম আবু হানীফা, ইমাম শাফেয়ী, ইমাম মালিকী রহিমাহুমুল্লাহ এর মত এটাই। শাইখ সালিহ আল মুনাজ্জিদের islamqa.info তে বলা হচ্ছে: যে বা যারা এভাবে ভাংতি পূরণ করতে গিয়ে শাওয়্যালের ৬ রোযা রাখতে পারছেন না, তারা যিলক্বদের মধ্যে পূরণ করলেও আল্লাহ শাওয়্যাল হিসেবে কবুল করবেন, ইনশাআল্লাহ।
.
এই মতামতের পক্ষেই অধিকাংশ উলামা, সুতরাং এটাই সবচে শক্ত দালীল ধরে নিচ্ছি।
.
❒ এবার দ্বিতীয় মতামতের আলেমগনের মতামত হচ্ছে,
.
مَنْ صَامَ رَمَضَانَ
.
যে রমাদানে রোযা রাখলো, এখানে বলা হয়নি যে রমাদান সম্পূর্ণ করলো, যে বা যারা সঙ্গত শরয়ী কারণে সম্পূর্ণ রোযা রাখতে পারেনি, তারাও এই পর্যায়েরই অন্তর্ভুক্ত, তারাও তো রমাদানে রোযা রেখেছে।
.
আবার আয়িশা রাদিয়াল্লাহু 'আনহার বক্তব্যে থেকে প্রমাণ পাওয়া যায় যে: রাসূল সা. এর খিদমত করতে গিয়ে কখনো কখনো উনার ভাংতি রোযা শেষ করতে শা'বান মাসও হয়ে যেতো। তার মানে কি উনি শাওয়্যালের রোযা রাখতেন না??
.
সাহাবাদের উক্তি থেকে আরও প্রমাণ পাওয়া যায় যে, উনারা অনেকেই যিলহজ্জ্ব মাসে অধিক মর্তবাহেতু এই মাসেই ভাংতি রোযা থাকলে সেগুলো রাখতেন। তারমানে উনারাও শাওয়্যাল রাখেননি?
.
এই দলের আলেমদের আরও ব্যাখ্যা হচ্ছে,
.
শাওয়ালের সিয়াম নফল হলেও রাখার সময়সীমা খুবই কম, ওদিকে ভাংতি রোযা ফরয হলেও সেটা পূরণের জন্য প্রশস্ত একটা সময় দেওয়া হয়েছে, কোথাও হয়নি যে শাওয়্যালের মধ্যেই এটা পূরণ করতে হবে।
.
এরকম একটা উপমা দেয়া হয় যে: মনে করুন, আপনার এক প্রতিবেশী হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছে, সে যেই হসপিটালে ভর্তি, সেখানে দেখা করতে যাওয়ার সময় মাত্র ২ ঘণ্টা, এর পরে আর যাওয়ার সুযোগ নেই। সেই একই সময়ে আপনার মা'ও অসুস্থ আছেন, কিন্তু মাকে দেখতে যাওয়ার কোন সময়সীমা নেই, সবসময়ই ঐ দরজা খোলা। এক্ষেত্রে আপনাকে অপশন দেয়া হলে আপনি কী করবেন?
.
অবশ্যই আগে ২ ঘণ্টার মধ্যে প্রতিবেশীকে দেখে এসে মায়ের কাছে যাবেন। মাকে দেখা ফরয হলেও সময়সীমা প্রশস্ত, আর প্রতিবেশীকে দেখা নফল হলেও সেটার সময়সীমা অল্প। এজন্য নফল কাজটি আগে করলে সমস্যা নেই।
.
হানাফী ফিকহ অনুযায়ী ফরযের আগে সময় থাকলে নফল পালনে অনুমতি রয়েছে। যেমন: কেউ যদি মাসজিদে ফরজ নামাযের জন্য যায় এবং ফরজ শুরু হওয়ার আগে সময় হাতে আছে, ঐ সময় সে নফল পড়তে চায়, তাহলে তা পড়া যাবে।
.
সুতরাং যেহেতু রামাদানের রোযা পূরণ করার জন্য ১ বছর সময় হাতে রয়েছে, কিন্তু শাওয়্যালের রোযা রাখার সময় মাত্র একমাস(★ তার মধ্যে পহেলা শাওয়াল ঈদ হওয়ায় রোযা রাখা হারাম+ মহিলারা বাকি ২৯ দিনের মধ্যেও আবার ৫/৭/১০ দিন অসুস্থ থাকবেন+ বিবাহিতদের জন্য নফল রোযা রাখার জন্যেও স্বামীর অনুমতির প্রয়োজন আছে, এর মধ্যে অনেকেই অন্যান্য শারীরিক অসুস্থতায়ও ভুগতে পারেন, সব মিলিয়ে অনেকের জন্য এই ১ মাসের মধ্যে রোযা রাখার মত ফাকা খুবই কম হয়ে যাচ্ছে), তাই কেউ চাইলে আগে শাওয়্যালের ৬ রোযা এই মাসে পূর্ণ করে তারপর বছরের অন্যান্য সময়ে ভাংতিগুলো পূরণ করে নিতে পারেন।
.
এই মতামতটি ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বল রহিমাহুল্লাহ এর। উনার পরেও সমসাময়িক আরও অনেক আলেম এর সপক্ষে মত দিয়েছেন।
.
❒ এই দলের উলামাদের মতামত হচ্ছে: কেউ যদি শাওয়্যাল মাসে ভাংতি রোযা রাখা শুরু করে, তাহলে সে আল্লাহ চাইলে শাওয়াল & ভাংতি দুটোরই সাওয়াব পাবে। এভাবে মিলিয়ে রাখার পক্ষেও বেশ কিছু দালীল দিয়েছেন উনারা।
.
তবে এই মতের বিপক্ষের মতামতই বেশি শক্ত: তারা বলছেন যে, ভাংতি রোযা রাখা কিংবা শাওয়্যালের রোযা রাখা: এই দুটো রোযা পুরো ভিন্ন দুটো ক্যাটাগরি, সুতরাং এক রোযায় দুই নিয়ত গ্রহণযোগ্য নয়।
.
যাই হোক, সবশেষে উপসংহার হচ্ছে এরকম,
.
● যে বা যারা ভাংতি রোযা আগে রেখে শাওয়্যালের ৬ রোযাও পূরণ করতে সক্ষম, তারা অবশ্যই আগে ভাংতি রাখবেন, কারণ ফরজের কাযা আগে পূরণ করাই বেশি জরুরী,(কে কখন মারা যাবে,আমরা জানিনা,লাখটা নফলও একটি ফরযের সমান নয়) এরপর শাওয়্যালের রোযা রাখবেন: কারণ জমহুরের মতামত এটাই।
.
● আর যারা এভাবে পূরণ করতে সক্ষম নন, তারা শাওয়্যালের রোযা আগে রাখতে চাইলে সেটারও অনুমতি আছে, ইনশাআল্লাহ। যেহেতু এই মতের পক্ষেও দালীল ও উলামাদের সমর্থন রয়েছে এবং আল্লাহ তা'আলা কারো উপর সাধ্যের অতিরিক্ত বোঝা চাপান না।
.
এবং আল্লাহ উত্তম জানলেওয়ালা, কবুল করার মালিকও তিনিই।

Post a Comment

0 Comments