মার্ক জাকারবার্গ হতে পারতেন, ইলন মাস্ক হতে পারতেন। কিন্ত তিনি হয়ে গেলেন লাশ


মার্ক জাকারবার্গ হতে পারতেন, ইলন মাস্ক হতে পারতেন। কিন্ত তিনি হয়ে গেলেন লাশ, শরীরের ছিন্নভিন্ন টুকরোগুলো নিয়ে তার প্রাণহীন দেহটা পড়ে রইলো ম্যানহাটনের বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে। মহীরূহ হয়ে ছায়া দেয়া শুরু করেছিলেন তিনি, তরুণ বাংলাদেশী উদ্যোক্তাদের মধ্যে তিনি ছিলেন সবচেয়ে সফলদের একজন। অথচ ফাহিম সালেহ নামের সেই তরুণ নৃশংসভাবে খুন হলেন নিউইয়র্কের ম্যানহাটনে, নিজের অ্যাপার্টমেন্টে। মাত্র ৩৩ বছর বয়স হয়েছিল ফাহিমের, পুলিশের ধারণা, ভাড়াটে প্রফেশনাল কিলারের কাজ এটা। ব্যবসায়ীক বা লেনদেন সংক্রান্ত কোন কারণে খুন হতে পারেন ফাহিম, এমনটাই ধারণা করছে নিউইয়র্কের পুলিশ। খুনের রহস্যভেদ হলেও অবশ্য ফাহিম ফিরে আসবেন না, যে রত্নটি চিরতরে হারিয়ে গেছে, তাকে আর ফিরে পাওয়া যাবে না কখনোই।

গতকাল ফাহিমের মৃত্যুর খবরটা আসার আগে আমাদের দেশের খুব বেশি মানুষ ফাহিম সালেহ'র নাম জানতেন না হয়তো, কারণ আড়ালে থেকেই কাজ করতে পছন্দ করতেন তিনি। পাঠাওয়ের সহ-প্রতিষ্ঠাতা তিনি, পরে নিজের অংশের শেয়ার বিক্রি করে পৃষ্ঠপোষক পদে ছিলেন। জোবাইক, যাত্রী-সহ আরও কিছু দারুণ প্রোজেক্টে তিনি ছিলেন বিনিয়োগকারী। এর বাইরে নাইজেরিয়াতে গোকাডা (Gokada) এবং কলাম্বিয়াতে পিকঅ্যাপ (Picap) নামে আরও দুটি রাইড শেয়ারিং কোম্পানি শুরু করেছিলেন, ভালো মুনাফাও অর্জন করেছিলেন সেখান থেকে।


ফাহিমের বাবা এবং মা দুজনেই ছিলেন বাংলাদেশী। বাবা সালেহ উদ্দিনের জন্ম ও বেড়ে ওঠা চট্টগ্রামে, আর মা নোয়াখালীর মানুষ। ফাহিমের জন্ম হয়েছিল সৌদি আরবে, বাবা সালেহ উদ্দিন তখন সেখানে কর্মরত ছিলেন। ফাহিমের জন্মের পরে তাদের পরিবার আমেরিকা চলে গিয়েছিল, ফাহিমের শৈশব-কৈশোরের সবটাই তাই আমেরিকাতেই কেটেছে। তিনি পড়াশোনা করেছেন ইনফরমেশন সিস্টেম নিয়ে, আমেরিকার বেন্টলি বিশ্ববিদ্যালয়ে।

দারুণ মেধাবী ছিলেন ফাহিম, মাথায় সারাক্ষণ নতুন নতুন আইডিয়া গিজগিজ করত। স্কুল জীবন থেকেই প্রযুক্তির প্রতি তার সীমাহীন আগ্রহ। মাত্র ১৬ বছর বয়সে তিনি টিনেজারদের জন্য সোশ্যাল নেটওয়ার্ক বানিয়েছিলেন, নাম টিন-হ্যাংআউট ডটকম। শুরুর দুই বছরের মাথায় বছরে বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রায় দেড় কোটি টাকা আয় হয় এই সাইট থেকে। আঠারো বছর বয়সেই কোটিপতি হয়ে গিয়েছিলেন ফাহিম! এরও আগে উইজ টিন নামের একটা ওয়েবসাইট তৈরি করে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন স্কুলে, বেশ ভালো অংকের টাকা আয় হয়েছিল তখনও।

ম্যানহাটনের এই অ্যাপার্টমেন্টে খুন হয়েছেন ফাহিম
ছোটবেলায় প্র‍্যাংক কল তো আমরা কমবেশি সবাই করেছি, আননোন নাম্বার থেকে কাউকে ফোন দিয়ে মজা করেছি। সেই আইডিয়াটা কাজে লাগিয়ে প্র‍্যাংক কলের একটা ওয়েবসাইট বানালেন। সেখানে কিছু রেকর্ডেড অডিও আপলোড করা ছিল, ইউজাররা সেসবের মধ্যে থেকে যেকোন একটা পছন্দ করে নিয়ে কারো সঙ্গে মজা করতে পারতেন। শুরুতে ব্যাপারটা ফ্রি ছিল, কিন্ত ইউজার বেড়ে যাচ্ছে দেখে ফাহিম এটাকে পেইড সার্ভিস বানিয়ে ফেললেন।

তিনি খানিকটা শঙ্কায় ছিলেন, টাকা দিয়ে মানুষ এরকম সার্ভিস ব্যবহার করবে কিনা। তাছাড়া প্র‍্যাংক কলের ইউজারদের বেশিরভাগ ছিল কিশোর, তাদের হাতে খুব বেশি টাকা থাকেও না। কিন্ত ফাহিমকে অবাক করে দিয়ে প্রতিদিন গড়ে বিশ ডলার করে অ্যাকাউন্টে ঢুকতে শুরু করলো। উৎসাহী হয়ে ফাহিম সেখানে অডিও'র পরিমাণ বাড়ালেন, ইউজারও বেড়ে গেল। বিশ থেকে শুরু হয়ে প্রতিদিন একশো-পাঁচশো এমনকি হাজার ডলারও আসা শুরু হলো। কয়েক বছরের মাথায় ফাহিম প্রায় এক মিলিয়ন ডলারেরও বেশি আয় করলেন এই প্র‍্যাংক কল সার্ভিস থেকে। তরুণ বয়সে তিনি যেসব প্রোজেক্টের পেছনে বিনিয়োগ করেছেন, সেগুলোর টাকা এসেছে এই প্র‍্যাংক কল সার্ভিস থেকেই।

পাঠাওয়ের তিনজন প্রতিষ্ঠাতার একজন ফাহিম সালেহ, তবে যুক্তরাষ্ট্রে থাকায় খুব বেশি মানুষের কাছে তিনি পরিচিত ছিলেন না। ২০১৪ সালে দেশে এসেছিলেন ফাহিম। ওই সময়ে যুক্ত হন রাইড শেয়ারিং কোম্পানি পাঠাওয়ের সঙ্গে। ২০১৫ সালে যখন বাইক রাইড শেয়ারিং নিয়ে কারো তেমন কোন ধারণাই ছিল না, তখন মাত্র ১০০টি বাইক নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল পাঠাও। সেই পাঠাও এখন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রাইড শেয়ারিং কোম্পানী, প্রায় ১ লক্ষ রাইডার কাজ করেন পাঠাওয়ে, প্রায় চার হাজার কোটি টাকা এই কোম্পানি মূল্যমান, কয়েক'শ কোটি ইনভেস্টমেন্ট। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, পাঠাওয়ের আগমনের কারণে অজস্র মানুষ অর্থনৈতিকভাবে উপকৃত হয়েছে। বেকার যুবকরা রাউড শেয়ারিংয়ে নাম লিখিয়েছে, মোটর সাইকেলের বিক্রি বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ।

ফাহিম সালেহ অকালে ঝরে যাওয়া এক মেধাবী প্রাণ
পাঠাওয়ের সাফল্যের পর ফাহিম নাইজেরিয়াতে গোকাডা এবং কলাম্বিয়াতে পিকঅ্যাপ নামে আরও দুটি রাইড শেয়ারিং কোম্পানি শুরু করেন। সেখান থেকেও ভালো পরিমাণের রেভিনিউ অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। আফ্রিকার বড়সড় বাজারটাকে ধরার প্ল্যান ছিল ফাহিমের, সেই লক্ষ্যেই এগিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। নাইজেরিয়ায় চালু করা গোকাডা সেদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাইড শেয়ারিং এ্যাপ ছিল। ফাহিমের স্বপ্ন ছিল রাইড শেয়ারিং অ্যাপসকে ভিন্নমাত্রার উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া!


কিন্ত আভ্যন্তরীন কিছু চাপের কারণে নাইজেরিয়া সরকার ফাহিমের গোকাডা রাইড সার্ভিসটি বন্ধ করে দিয়েছিল। তখন ফাহিম সেটিকে পার্সেল সার্ভিসে পরিণত করেন। তবে বন্ধ হবার আগে এক বছরে গোকাডা থেকে ফাহিমের আয় হয়েছিল ৫৩ লক্ষ ডলারেরও বেশি! ফাহিমের মৃত্যুর সঙ্গে এই ব্যাপারটার একটা সংযোগ থাকতে পারে বলে মনে করছেন অনেকে। নাইজেরিয়ার লাগোস শহরের মাফিয়ারা ফাহিমের এই ব্যবসাটাকে ভালো চোখে দেখছিল না, সরকারের ওপর চাপ দিয়ে তারাই গোকাডা'র রাইড সার্ভিস বন্ধ করে দিয়েছে বলে ফাহিম মনে করতেন। বাবার সঙ্গে কথাবার্তায় তিনি একবার বলেছিলেন, 'নাইজেরিয়ানদের ব্যবহার খুব খারাপ, আর তাদের সাথে ব্যবসা করাটাও কঠিন।'

প্রবাসী বাংলাদেশীদের মধ্যে ফাহিমের পরিচয় ছিল 'বাংলাদেশী ইলন মাস্ক' নামে। উদ্যোক্তা হিসেবে তিনি সাহসী ছিলেন, ঝুঁকি নিতে ভয় পেতেন না কখনও। তাই তো নাইজেরিয়া থেকে নেপাল বা কলম্বিয়া- ছুটে গেছেন সব জায়গায়। নতুন কোন উদ্যোগ তার পছন্দ হলে সেটার পাশে দাঁড়াতেন সাধ্যমতো, বাংলাদেশেই যেমন জোবাইক এবং যাত্রীতে বিনিয়োগ করেছেন তিনি। নিজে যা জানতেন সেগুলো অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করতেন সবসময়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মজা করতেন ভীষণ। অল্প বয়সে দারুণ খ্যাতির দেখা পেয়েছেন, কিন্ত অহংকার তাকে গ্রাস করতে পারেনি।

ফাহিম সালেহ মার্ক জাকারবার্গ হতে পারতেন, ইলন মাস্ক হতে পারতেন। কিন্ত তিনি হয়ে গেলেন লাশ, শরীরের খন্ড-বিখন্ড টুকরোগুলো নিয়ে তার প্রাণহীন দেহটা পড়ে রইলো ম্যানহাটনের বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে, যে ফ্ল্যাটটা বছরখানেক আগেই আড়াই মিলিয়ন ডলার দামে কিনেছিলেন তিনি, যেখানে বসে নিজের সৃজনশীল আইডিয়াগুলো নিয়ে ভাবতেন ফাহিম। ফাহিমের এই অকাল মৃত্যুতে পৃথিবীর কি ক্ষতি হয়েছে জানিনা, তবে বাংলাদেশ তার এক রত্নকে হারালো, এমন মেধাবী উদ্যোক্তা যত্রতত্র পাওয়া যায় না। ফাহিম সালেহরা যুগে যুগে জন্মান, ফাহিমের মতো কাউকে পেতে হলে বাংলাদেশকে কত বছর অপেক্ষা করতে হবে, সেটা কেউ জানে না...

Post a Comment

0 Comments